রামায়ণ, অযোদ্ধা কান্ড ১ম খন্ড ১ম সর্গ

রামায়ণঃ অযোদ্ধা কান্ড ১ম খন্ড ১ম সর্গ

রামায়ণঃ অযোদ্ধা কান্ড ১ম খন্ড ১ম সর্গ

রাজকুমার ভরত যৎকালে মাতুলালরে গমন করেন, তখন প্রেমাস্পদ শত্রঘ্নকেও, সমভিব্যাহারে লইয়া যান। ঐ উভ্যয় ভ্রাতা তথায় মাতুল যুথাজিতের প্রযত্নে অপত্যনির্বিশেষে আদৃত ও প্রতিপালিত হইয়াও বৃদ্ধ পিতাকে এক ক্ষনের নিমিত্ত ভুলেন নাই৷ রাজা দশরথও তাঁহাদিগকে বিস্মৃত হন নাই। তিনি স্বর্দেহনির্গত বাহুচতুষ্টয়ের ন্যায় চারিটি পুত্রকে যথেষ্ট স্নেহ করিতেন। কিন্তু যদিও তাঁহার তনয়েরা, তাঁহার অতিমাত্র স্নেছের পাত্র ছিলেন, তথাচ তিনি রামকেই অপেক্ষারত প্রীতির সহিত দেখিতেন। রাম ভূতগণের মধ্যে স্বয়ামভুর ন্যায় অন্যান্য সাধারণ গুণ ধারণ করিতেন। তিনি সাক্ষাৎ নারায়ণ, সুর গনের অনুরোধে বাহুবলগর্ভিত রাক্ষসরাজ রাবণের বধ সাধন করিবার নির্মিত্ত মর্ত্ত্য লোকে রামরূপে অবতীর্ণ হইয়াছেন।


ফলতঃ দেবমাতা অদিতি যেমন বজ্রধর পুরন্দর দ্বারা শোভিত হন, সেইরূপ দেবী কৌশল্যাও এই অমিততেজা আত্মজ, রামকে পাইয়া যায় পর নাই শোভা ধারণ করিয়াছিলেন।


এই মহাবীর রাম অস্থয়াশুন্য, ও প্রিয়দর্শন। ভূতলে তাঁহার তুলনা নাই। তিনি পিতার ন্যায় গুণবান এবং প্রশান্ত স্বভাব। তিনি মৃদবচনে সকলের সহিত সম্ভাষণ করিয়া থাকেন। কেহ তাঁহার প্রতি পরুষ বাক্য প্রয়োগ করিলে তিনি ঐরূপ কথা কখনই ওষ্ঠের বাহির করেন না। অন্যকৃত একটিমাত্র উপকারেও তাহার পরিতোষ জন্মে এবং অপকার অনন্ত হইলে স্বীয় উদারগুণে সমগ্র বিস্মৃত হন। তিনি অস্ত্রভ্যাসের,অবকাশকালেও শুশীল বয়োবৃদ্ধ জ্ঞানী সাধুগনে সে পরিবৃত হইয়া শান্তরহস্য অনুশীলন করিয়া থাকেন। তিনি বুদ্ধিমান ও প্রিয়ংবদ। কেহ অভ্যাগত হইলে তিনি সর্বাগ্রে তাহার সহিত আলাপ করিয়া থাকেন। তিনি অতি বলবান, কিন্তু আপনার বীর্ষ্যমদে কখনই উন্মত্ত হন না। তিনি সত্যবাদী বিধান ও বৃদ্ধবর্গের মর্য্যাদাপালক। তিনি প্রজারঞ্জন, প্রজারাও তাহার প্রতি যথাচিত অনুরাগ প্রদর্শন করিয়া থাকে। তিনি বিপ্রভক্তিপরায়ন ও দীনশরণ। তাঁহার চরিত্র অতি পবিত্র। তিনি দুষ্টের নিয়ন্তা, ধর্মাজ্ঞ ও দেশকালজ্ঞ। তাঁহার বুদ্ধি স্বীয় বংশেরই অনুরুপ।


রামায়ণঃ অযোদ্ধা কান্ড ১ম খন্ড ১ম সর্গ

এই কারণে তিনি ক্ষত্রিয় ধর্মকে বহুমান করিয়া থাকেন এবং ঐ ধর্ম রক্ষা করিলে যে সর্গ লাভ হয়, ঐই তাহার স্থির বিশ্বাস । অমংগল প্রসঙ্গে ও ধর্মবিরুদ্ধ কথায় তাঁহার অভিরুচি নাই। কোন প্রস্তাব উত্থাপিত হইলে তিনি সুরগুরু বৃহস্পতির ন্যায় তাহাতে উত্তরোত্তর যুক্তি প্রদর্শন করিতে পারেন। তাঁহার অঙ্গ প্রত্যঙ্গ সমুদায় স্থুলক্ষনসম্পন্ন। তিনি তরুণ ও নীরোগ এবং পুরুষপরীক্ষায় সুদক্ষ । জগতে তিনিই একমাত্র সাধু। সেই রাজকুমার প্রকৃতিবর্গের বহিশ্চর, প্রাণের ন্যায় একান্ত প্রিয়তর। তিনি বেদ বেদাংগে অধিকার লাভ করিয়া গুরুগৃহ হইতে সমাবর্তন করিয়াছেন। সমস্ত্র ও অমন্ত্রক অস্ত্র শস্ত্রে তিনিই সর্বশ্রেষ্ঠ। তিনি কল্যাণের জন্মভূমি তেজশ্রী ও সরল। সঙ্কট স্থলেও তিনি কখন মিথ্যাবাক্য প্রয়োগ করেন না। ধর্মার্থদর্ষী বৃদ্ধ ব্রাম্মণেরা তাহার আচার্য্য তাঁহার আচার্য্য। তিনি ত্রিবর্গ-তত্তজ্ঞ স্মৃতিমান ও প্রতিভাসম্পন্ন। তিনি লৌকিকার্থ-কুশল বিনীত গম্ভীর গূঢমন্ত্র ও সহায়সম্পন্ন। তাঁহার ক্রোঢ ও হর্ষ কখনোই নিষ্ফল হয় না। অর্থ যে ন্যাযানুসারে উপার্জন ও সৎ পাত্রে দান করিতে হয় তিনি তাঁহা বিলক্ষন জ্ঞাত আছেন। গুরুজনের প্রতি তাঁহার ভক্তি অতি অসাধারণ। তিনি অসৎ বস্ত্র গ্রহনে কখনই লোলুপ নহেন। তিনি আলস্য-শন্য সাবধান এবং স্বদোষদর্ষী। তিনি কৃতজ্ঞ ওপ লোকের অন্তরজ্ঞ।


তিনি ন্যায়ানুসারে নির্গ্রহ ও অনুগ্রহ প্রদর্শন করিয়া থাকেন। কাব্য ও দর্শন শাস্ত্রে তাঁহার সবিশেষ ব্যুৎপত্তি লাভ হইয়াছে এবং তিনি ধর্ম ও অর্থের অবিরোধে সুখ সংগ্রহ করিয়া থাকেন। কর্তব্যভার বহনে তাঁহার আলসা নাই। যে সমস্ত শিল্প বিহারকালে বিশেষ উপযোগী, তিনি তৎ সমুদায় আয়াত্ত, করিয়াছেন। তিনি অর্থবিভাগে সুপটু। হস্তী ও অশ্বে আরোহণ ও উহাদিগকে শিক্ষা দান এই উভয় কর্মেই তিনি সুদক্ষ্য। বিপক্ষ সৈন্যের অভিমুখে গমন শত্রু সংহার ও ব্যুহরচনা এই সমস্ত কর্মে তিনি সুপারগ। তিনি ধনুর্বেদজ্ঞগণের অগ্রগণ্য ও অতিরথ। দেবাসুরগন রোষাবিষ্ট হইলেও তাঁহাকে সংগ্রামে পরাভব করিতে পারেন না। তিনি কোন অংশে লোকের অবজ্ঞাভাজন নহেন। তিনি কালের অনায়ত্ত ও ত্রিলোকপুজিত। তিনি ক্ষমা গুনে পৃথিবীর ন্যায়, বুদ্ধিতে বৃহস্পতির ন্যায় এবং বলগীর্ষে সুরপতি ইন্দ্রের ন্যায় অভিহিত হইয়া থাকেন। রাম পিতার প্রীতিকর প্রকৃতি বর্গের কমণীয়, এইরূপ গুণগ্রামে করজাল মণ্ডিত প্রদীপ্ত সূর্ষ্যমশুলের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিলেন। তখন দেবী বসুমতী এই সচ্চরিত্র অধ্যুষ্যপরাক্রম লোকনাথ -সদৃশ রাম কে অধিনাথ রুপে প্রার্থনা করিলেন। বৃদ্ধ রাজা দশরথ রাম এই প্রকারে গুপবান হইয়াছেন দেখিয়া ভাবিলেন, আমার জীবদ্দশার বৎস রাজা হইবেন তদ্দর্শনে না জানিি আমার কিরুপ আনান্দই হইবে।


কবে আমি প্রিয়পুত্র রামকে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত দেখিব। রাম সততই লোকের অভ্যদয় প্রার্থনা করিয়া থাকেন। সকল জীবেই তাহার দয়া দেখিতে পাওয়া যায় এবং তিনি জলবর্ষী জলদের ন্যায় আমা অপেক্ষা সকলেরই প্রিয়। যম ও ইন্দ্রের ন্যায় তাঁহার বল, বৃহস্পতির ন্যায় তাঁহার বুদ্ধি, পর্ব্বতের ন্যায় তাঁহার ধৈর্য্য। অধিক কি, তিনি আমা অপেক্ষা সৰ্ব্বাংশেই গুণবান। আমি এই বৃদ্ধ বয়সে তাঁহাকে এই পৃথিবী সাম্রাজ্যের উপর আধিপত্য বিস্তার করিতে দেখিয়া স্বর্গ লাভ করিব।


অনন্তর মহারাজ দশরথ রামকে এইরূপ ও অন্যান্য রূপ অন্যনৃপতিদুর্লভ অপরিচ্ছিন্ন সর্বোৎকৃষ্ট গুনে অলংকৃত দেখিয়া মন্ত্রিগণের সহিত পরামর্শ করতে তাহাকে যৌবরাজ্য প্রদানের বাসনা করিলেন। তিনি তাঁহাকে যৌবরাজ্য প্রদানের বাসনা করিয়া মুস্ত্রিগণকে কহিলেন, মন্ত্রিগণ! আমর দেহে জরার সঞ্চার হইয়াছে এবং অন্তরীক্ষে গ্রহ নক্ষত্রের প্রতিকূলতা বাত্যা ও ভূমিকম্প প্রভৃতি নানা প্রকার উৎ পাতও হইতেছে এই কারণে এই যৌবরাজ্য প্রদান-প্রস্তাব-আমার শোকাপহরণ পূর্ণচন্দ্র্সুন্দ্রানন লোকাভিরাম রা ও প্রকৃতি বর্গে সবিশেষ প্রীতিকর হইবো।


তখন সেই রাজাধিরাজ যোগ্য অবসরে আপনার ও প্রজাগনের হিতার্থ এবং রামের ও প্রজাগণের প্রতি স্নেহ-প্রদর্শনার্থ রাম কে যৌবরাজ্যে অভিষেক করিতে যত্নবান হইলেন। তিনি মন্ত্রিগন দ্বারা নানা নগর ও জনপদের প্রধান প্রধান লোকদিগেকে আনয়ম করাইলেন এবং মর্যাদা অনুসারে তাঁহা দিগকে বাসগৃহ ও নানা প্রকার আভারণ প্রদান করিলেন। কিন্তু তৎকালে কৈকয়রাজ ও মিথিলাধিনাথ জনককে এই সংবাদ প্রদান করা যুক্তিসিদ্ধ বিবেচনা করিলেন না। তিনি মনে করিলেন ইহারা অতঃপর এই প্রিয় সমাচার অবশ্যই পাইবেন। অনন্তর বিজয়ী রাজা দশরুধ সভাভবনে উপবেশন করিয়া আছেন, ইত্যবসরে লোকপ্রিয় পার্থিবগন আগমন করিতে লাগিলেন। সেই সমস্ত অধীন রাজা উপস্থিত হইয়া দশরথ প্রদর্শিত আসনে তাঁহারই অভিমুখে উপবেশন করিলেন। ইহারা রাজভক্তি প্রদর্শনের নিমিত্ত প্রায়ই অযোদ্ধায় বাস করিয়া থাকেন । ইহরা অতি বিনীত। রাজা দশরথও ইহাদিগকে সবিশেষ সম্মান করিয়া থাকেন। ইহারা ও জন পদবাসী প্রধান প্রধান লোকেরা দশরথের সম্মুখে উপবেশন করিলেে তিনি অমরগণপরিবৃত শুররাজ ইন্দ্রের ন্যায় শোভাতে লাগিলেন।


মহাভারত প্রথম খন্ড। শৌনকের আশ্রমে সৌতি। আদিপর্ব/মহাভারত।
নবীনতর পূর্বতন