উপাখ্যান - সততার পুরস্কার
উপাখ্যান - সততার পুরস্কার
ছেলেটির নাম তৃণীর গ্রামের এক দরিদ্র মাতা পিতার একমাত্র সন্তান বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পিতা মাতাকে হারিয়ে সে অনাথ হয়ে পড়ে। অর্থাভাবে পড়ালেখা তেমন করতে পারেনি গ্রামে কাজ কর্মের খুবই অভাব । তাই একদিন সে গ্রাম ছেড়ে শহরে আসে কাজের সন্ধানে শহরে এসে হাঁটতে হাঁটতে একটি দোকানে এসে দোকানদারকে বলল, “কাকু, আমি খুব তৃষ্ণার্ত আমাকে এক গ্লাস জল দেবেন?”
দোকানদারের নাম দয়াল বসাক । তিনি ছেলেটির দিকে তাকিয়ে বললেন, “এখানে বস, তোমার নাম কী? কোথায় থাক?" দোকানদারের কথায় সে বসল এবং বলল, "আমার নাম তূণীর অনেক দূরের গ্রাম থেকে এসেছি কাজের সন্ধানে।" দোকানদার তাকে এক গ্লাস জল দিয়ে আলাপচারিতা সেৱে কী যেন ভেবে হঠাৎ বললেন, “তুমি এখানে একটু বসে থাক আমি একটু বাইরে থেকে ঘুরে আসি ।" তৃণীরকে দোকানে বসিয়ে দোকানদার বেরিয়ে গেল । তৃণীর দোকানে বসে দোকান পাহাড়া দিতে লাগল কিন্তু অনেক সময় হয়ে গেল দোকানদার ফিরে আসছেনা। এখন সে কী করবে? দোকান ফেলে কোথাও যেতেও পারেনা । এরই মধ্যে কয়েকজন ক্রেতাও এসেছে শাড়ী কিনতে । শাড়ীর গায়ে দাম লেখা ছিল । তাই শাড়ী বিক্রি করতে তৃণীরের কোন অসুবিধা হল না । কারণ বাবার সাথে তৃণীর ছোট বেলায় হাটে বাজারে কাপড় বেচা কেনা করেছে । সারাদিনে সে বেশ কয়েকটি কাপড় বিক্রি করল। দুপুর গড়িয়ে বিকেল, বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হয়ে গেল । কিন্তু দোকানদারের দেখা নেই। উপায়ান্তর না দেখে তৃণীর দোকান বন্ধ করে সেখানে রাত কাটাল ।
দলগত কাজ : তৃণীর দোকান ত্যাগ করে চলে গেল না কেন ?
পরের দিনও দোকানদার এলেন না। তৃণীর আর কী করে? সে দোকান খুলে বসে রইল। সারাদিন দোকানে সে কাপড় বিক্রি করে কাটাল । দোকানদার সেদিনও ফিরে এলেন না । এভাবে দিন যায়, মাস যায় । কিন্তু দোকানদার আর ফিরে এলেন না । উপায়ন্ত না দেখে তৃণীর দোকান চালাতে লাগল । আর দোকানদারের জন্য অপেক্ষায় রইল। ব্যবসায়ী মহলে তার যথেষ্ট নামডাকও হয়েছে । সকলেই তাকে সম্মান করে। তার চারটি দোকান, অনেক কর্মচারী কাজ করে। সে দোকানগুলোর দেখাশুনা করে। কর্মচারীদের বেতন দেয়, দোকানের হিসেব পত্র দেখে। সে এখন খুবই ব্যস্ত
একদিন তৃণীর দোকানের গদিতে বসে আছে। এমন সময় দেখে এক বৃদ্ধ লোক পাঠিতে ভর করে তার দোকানের সামনে এসে তৃণীরকে খুঁজছে । তার পরনে ছেঁড়া ময়লা কাপড় । শরীর খুবই দুর্বল ও রুগ্ন । দেখে তাকে ভিক্ষুক বলেই মনে হয়। কিন্তু তৃণীর তার দিকে তাকিয়ে তাকে চিনতে পারল সে তাড়াতাড়ি গদি থেকে নেমে তার কাছে গেল । তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল, "কাকু, আমাকে চিনতে পরেননি? আমি তৃণীর । আমি এতদিন ধরে আপনার দোকান পাহাড়া দিয়ে আসছি। দোকান ছেড়ে কোথাও যাইনি । দোকানের আয় দিয়ে আরও ব্যবসা বাড়িয়েছি আপনার কোন ক্ষতি হতে দেইনি আপনি এসেছেন তাই এবার আমার ছুটি । আপনি আপনার দোকান বুঝে নিন।” বৃদ্ধ দোকানদার তৃণীরের সততায় মুগ্ধ হয়ে তার দিকে তাকিয়ে চোখের জল ফেলতে লাগলেন। তিনি বললেন, “না তৃণীর, আমার আর কোন কিছুরই প্রয়োজন নেই এ সবই তোমার আমার স্ত্রী পুত্র কন্যা সবাই আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। এখন তুমি ছাড়া এ জগতে আমার কেউ নেই ।”
তিনি বললেন, “সেদিন তোমাকে দোকানে রেখে বাইরে গিয়ে সংবাদ পেলাম আমার স্ত্রী মৃত্যুশয্যায়। তাই দ্রুত বাড়ি চলে যাই। গিয়ে দেখি আমার স্ত্রী মারা গিয়েছে। তার কয়েকদিন পর ছেলে মেয়ে দুটোও মারা যায় । তারপর সংসারের ঝামেলার মধ্যে আর থাকতে ইচ্ছে করল না। আশ্রমে আশ্রমে থাকি, তাই তোমার আর কোন খোঁজ খবরও নিতে পারিনি। কিছু হারিয়েও আমি ঈশ্বরের কৃপায় ভালো আছি। হঠাৎ তোমার নামটা মনে পড়ল, তাই ছুটে এলাম। তোমাকে খুঁজে পাব একথা ভাবিনি। তোমাকে এ অবস্থায় দেখে আমার যে কী আনন্দ হচ্ছে তা বলে বুঝাতে পারব না। তুমি আমার দোকান রক্ষা করেছ, আবার আমাকে দেখেই চিনতে পেরেছ এবং দোকান আমাকে দিতেও চেয়েছ । এটা কয়জন করে ? তুমি মানুষ নও, তুমি দেবতা । আমি তোমাকে আশীর্বাদ করি তুমি আরও অনেক বড় হবে ।" তৃণীর বলল, “কাকু - আপনি আমার পিতার মত। আপনি আমাকে বিশ্বাস করে দোকান ফেলে রেখে চলে গিয়েছিলেন। আমি সে বিশ্বাসের মর্যাদা রক্ষা করতে পেরেছি । এটাই আমার সান্ত্বনা । আমি এর বেশি আর কিছু চাই না।” দয়াল ব্যাক বললেন, “বাবা তৃণীর। তুমি যা করেছ, তা কয়জন করে? সকলেই নিজের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য অন্যকে ঠকাতে চায় । আর তুমি আমার সেই ছোট দোকান শুধু রক্ষাই করনি, তার আয় থেকে উদ্ধৃতি করে আরো ব্যবসা বাড়িয়েছ। এ সবই তোমার । এটাই তোমার পুরস্কার । তুমিই এর প্রকৃত মালিক ।" কিন্তু তৃণীর তার গ্রামে ফিরে যেতে চাইলেও দয়াল বসাক আর তাকে ছাড়েননি ।
উপাখ্যানের শিক্ষাঃ জীবনকে সার্থক করে গড়ে তোলার জন্য সততা একটি উৎকৃষ্ট পথ। সততা না থাকলে মানুষ আর পশুর মধ্যে কোন পার্থক্য থাকে না । সততা মানুষকে ভালমন্দের পার্থক্য চোখে আঙ্গু নিয়ে দেখিয়ে দেয়। সৎ মানুষকে সকলেই শ্রদ্ধা করে, ভালোবাসে। এ বিশ্বে যত মহাপুরুষ জন্মগ্রহণ করেছেন, তারা সকলেই সততার ধারক ও বাহক। সততার জন্য তারা নিজের জীবন উৎসর্গ করতেও দ্বিধাবোধ করেন নি। সত্য প্রকাশ করাই তাদের জীবনের ব্রত।
সৎ-এর বিপরীত হল অসৎ। যিনি অসৎ তিনি সত্যকে গোপন করেন। মিথ্যাকে আশ্রয় করে সমাজে প্রতিষ্ঠা পেতে চান। ধর্মাধর্ম, ন্যায়-অন্যায় বিচার করেন না। সাময়িকভাবে তিনি সমাজে প্রভাব বিস্তার করতে পারলেও তা কখনো চিরস্থায়ী হয় না। কারণ মিথ্যা ক্ষণস্থায়ী। মানুষ তাকে কখনো ভালোবাসেনা, শ্রদ্ধার চোখে দেখে না । সকলেই তাকে ঘৃণা করে, এড়িয়ে চলতে চায় । কেউ তাকে বিশ্বাস করে না ।
তাই আমরা কখনো অসৎ পথে চলব না, অন্যায় কাজ করব না। সকলে সৎপথে চলব, সত্য কথা বলব এবং উপাখ্যানের তৃণীরের মত সততার সাথে সকল কাজ করব । সবসময় মনে রাখব যে, 'সততাই সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা' ।
একক কাজঃ তোমার মতে কেন সততাকে সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা বলা হয়?