বেদ ও তাঁর তিনটি শিষ্য উতঙ্ক, পৌষ্য ও তক্ষক। আদিপর্ব, মহাভারত।

বেদ ও তাঁর তিনটি শিষ্য উতঙ্ক, পৌষ্য ও তক্ষক। আদিপর্ব, মহাভারত।

বেদ ও তাঁর তিনটি শিষ্য অতঙ্ক, পৌষ্য ও তক্ষক

উতঙ্ক গুরুশিক্ষা ও গুরুদক্ষিনা

উপাদ্ধ্যয়ের আজ্ঞা নিয়ে বেদ গৃহআশ্রমে প্রবেশ করলেন, তাঁর ও তিনটি শিষ্য হল। তিনি শিষ্যদের বলতেন না যে এই কর্ম করো বা অন কর্ম করো। অতবা আমার সেবা করো। গুরুগৃহবাসের দুঃখ তিনি জানতেন সেই জন্য শিষ্যদের কষ্ট দিতে চাইতেন না।


কিছুকাল পরে জনমেজয় এবং পৌষ্য নামে আরেক রাজা বেদ কে উপাধ্যায়ের পদে বরণ করলেন। একদা বেদ যাজন কার্যের জন্য বিদেশে যাবার সময় উতঙ্ক নামক শিষ্যকে বলে গেলেন, আমার প্রবাসকালে গৃহে যে বিষয়ের অভাব হবে তুমি তা পুরণ করবে। উতঙ্ক গুরুগৃহে থেকে সকল কর্তব্য পালন করতে লাগলো। একদিন আশ্রমের নারীরা তাঁকে বললেন, তোমার উপাধ্যায়ানী ঋতুমতী হয়েছেন কিন্তু তোমার উপাদ্ধ্যায় এখানে নেই; ঋতু যাতে নিষ্ফল না হয় তুমি তা কর। উতঙ্কক উত্তর দিলেন আমি স্ত্রীলোকের কথায় এমন করতে অকার্য করতে পারিনা। উপাদ্ধ্যায় আমাকে অকার্য করবার আদেশ দেন নি। কিছুকাল পরে বেদ ফিরে এলেন এবং সকল কথা শুনে প্রীত হলেন এবং বললেন বালক উতঙ্ক আমি তোমার কি প্রিয়সাধন করবো বলো। তুমি ধর্মানুসারে আমার সেব করেছো। আমাদের পরেস্পরের প্রীতি বৃদ্ধি পেয়েছে। তোমার সকল কামনা পূর্ণ হবে। এখন তুমি নিজ গৃহে যেতে পারো।


উতঙ্ক বললেন আমিই বা আপনার কি প্রিয়সাধন করবো বলুন, আমি আপনার অভীষ্ট দক্ষিনা দিতে ইচ্ছে করি। বেদ বললেন বালক এখন থাকুক না। কিছুকাল পরে উতঙ্ক পুনর্বার গুরুকে দক্ষিনার কথা জিজ্ঞেস করলেন। বেদ বললেন, তুমি বহুবার আমাকে দক্ষিনার কথা বলেছ। গৃহমধ্যে যাও আর গীয়ে উপাদ্ধ্যায়নীকে জিজ্ঞাসা কর কি দিতে হবে। তখন উতঙ্ক গৃহপত্নীর কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন। ভগবতী উপাধ্যায় আমাকে গৃহ গমনের অনুমতি দিয়েছেন আমি দক্ষিনা দিয়ে ঋন মুক্ত হতে চাই, আপনি আমাকে বলুন কি দক্ষিনা দেব। উপাধ্যায় পত্নী বললেন, তুমি রাজ পৌষ্যের কাছে যাও, তাঁর ক্ষত্রীয়াপত্নী যে দুই কুন্ডল পরেন তাই চেয়ে আনো।


উতঙ্ক ও উপাদ্ধায়নীর ইচ্ছে পুরণ

চারদিন পরে পুন্যক ব্রত হবে। তাতে আমি ওই কুন্ডল শোভিত হয়ে ব্রহ্মনদের পরিবেশন করতে ইচ্ছা প্রকাশ করি। তুমি আমার এই অভীষ্ট পূর্ণ কর। তাহলে তোমার মঙল হবে। কিন্তু যদি না করো তবে অনিষ্ট হবে।


উতঙ্ক কুন্ডল আনবার জন্য যাত্রা শুরু করলেন। পথে যেতে যেতে তিনি প্রকান্ড বৃষে আরঢ় এক মহাকায় পুরুষ্কে দেখতে পেলেন। সেই পুরুষ বললেন উতঙ্ক তুমি এই বৃষের পুরীষ ভক্ষন কর। উতঙ্ককে অনিচ্ছুক দেখে তিনি আবার বললেন উতঙ্ক খাও বিচার করোনা। তোমার উপাধ্যায় ও পূর্বে খেয়েছেন। তখন উতঙ্ক বৃষের মলমুত্র খেলেন এবং দাঁড়িয়ে উঠে সত্তর আচমন করে পৌষ্যের নিকট যাত্রা শুরু করলেন।


পৌষ্য তাঁকে বললেন ভগবান কি আজ্ঞা বলুন। উতঙ্ক কুন্ডল প্রার্থিনা করলে রাজা বললেন, আপনি অন্তপুরে গিয়ে মহিষীর কাছে চেয়ে নিন। উতঙ্ক মহিষীকে দেখতে না পেয়ে ফিরে এসে পৌষ্যকে বললেন আমাকে মিথ্যে কথা বলা আপনার উচত হয়নি। অন্তপুরে মহিষি নেই। পৌষ্য ক্ষনকাল চিন্তা করে বললেন, নিশ্চয় আপনি উছিষ্ট বা এটো মুখে আছেন, অশুচি ব্যক্তি আমার পতিব্রতা ভার্যাকে দেখতে পায়না। উতঙ্ক মনে করে বললেন, আমি এখানে শীঘ্র আসবার জন্য দাঁড়িয়ে আচমন করেছিলাম সেইজন্য এই দোষ হয়েছে। উতঙ্ক তখন পূর্ব মুখে বসে হাত পা ধুয়ে এবং তিনবার নিঃশব্দে ফেনশুন্য অনুষ্ণ হৃদ্য জল পান করে দুবার মুখাদি ইন্দ্রিয় মুছলেন।


তারপর তিনি অন্তপুরে গিয়ে মহিষাকে দেখতে পেলেন। উতঙ্ককের প্রার্থনা শুনে মহিষী প্রীত হয়ে তাঁকে কুন্ডল দিলেন এবং বললেন,নাগরাজ তক্ষক এই কুন্ডল দুটির পার্থী। অতএব সাধধানে যাও। উতঙ্ক সন্তুষ্ট হয়ে পৌষ্যের কাছে এলেন। পৌষ্য বললেন, ভগবান সৎপাত্র সহজে পাওয়া যায়না। আপনি গৃহেবান অতিথী, আপনার সৎকার করতে ইচ্ছে করি। উতঙ্ক বললেন গৃহবান অতিথী। আপনার সৎকার করতে ইচ্ছে করি। উতঙ্ক বললেন গৃহে যে অন্ন আছে তাই শীঘ্র নিয়ে আসুন। অন্ন আনা হলে উতঙ্ক দেখলেন তা ঠান্ডা এবং তাতে চুল রয়েছে। তিনি বললেন আমাকে অশুচি অন্ন দিয়েছেন অতএব আপনি অন্ধ হবেন। পৌষ্য বললেন, আপনি নির্দোষ অন্নের দোষ দিচ্ছেন এই জন্য আপনি নিঃসন্তান হবেন। উতঙ্ক বললেন, অশুচি অন্নে দিয়ে আবার অভিশাপ দেওয়া আপনার অনুচিত দেখুন না অন্ন অশুচি কি না। রাজা অন্য দেখে অনুমান করলেন এই শীতল অন্ন কোনও মুক্তকেশী স্ত্রী এনেছে, তারই কেষ এতে পড়েছে। তিনি ক্ষমা চাইলে উতঙ্ক বললেন্ম আমার বাক্য মিথ্যে হবেনা , আপনি অন্ধ হবেন, কিন্তু শীঘ্রই আবার দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাবেন। আমাকে যে শাপ দিয়েছেন তাও যে না ফলে। রাজা বললেন, আমার ক্রোধ এখনও শান্ত হয়নি, ব্রাহ্মনের হ্রদয় নমনীততুল্য কিন্তু বাক্যে তীক্ষুধার ক্ষুর রয়েছে। ক্ষত্রীয়ের এর বিপরীত। আমি শাপ প্রত্যাহার করতে পারিনা, আপনি চলে যান। উতঙ্ক বললেন আপনি অন্নের দোষ সবীকার করেছেন অতএব আপনার শাপ ফলবে না। এই বলে তিনি কুন্ডল নিয়ে চলে গেলেন।


উতঙ্ক যেতে যেতে পথে এক নগ্ন ক্ষপণক দেখতে পেলেন। যে মাঝে মাঝে হারিয়ে যাচ্ছেন আবার ফিরে আসছেন। কিন্তু উতঙ্ক কুণ্ডল দুটি ভুমিতে রেখে স্নানাদীর জন্য জলাশয়ের গেলেন। সেই সময় ক্ষপণক কুন্ডল দুটি নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় স্নান শেসে উতঙ্ক তা দেখতে পেয়ে ক্ষপণক কে ধরে ফেললেন। আর সাথে সাথে তক্ষকের রুপ ধারণ করলেন ক্ষপণক। কিন্তু তক্ষক তখন নিজের রুপ নিয়ে এক গর্তে প্রবেশ করে নাগ লোকে চলে গেলেন। উতঙ্ক অনেক চেষ্টা করেও গর্ত খুরে ভীতরে প্রবেশ করতে না পেরে যখন ক্লান্ত হয়ে গেলেন তখন ভগবান ইন্দ্র তাঁর ব্জ্র দিয়ে গর্ত বর করতে সাহায্য করলেন তখন বড় হয়ে যাওয়া গর্ত দিয়ে উতঙ্ক নাগ লোকে গেলেন। আর সেখানে গিয়ে দেখলেন নানাবিধ প্রাসাদ ও ক্রীড়াস্থানাদি দেখতে পেলেন। কুণ্ডল ফিরে পাবার জন্য নাগগনের স্তব করতে লাগলেন। স্তব শেসে দেখলেন সেখানে দুই স্ত্রী কাপড় বুনছে। ছয় কুমার একটি চক্র ঘোরাচ্ছে। একজন সুদর্শন পুরুষ একটি অশ্বও সেখানে রয়েছে। উতঙ্ক এই সকলের স্তব করলেন। সেখানে থাকা এই পুরুষ উতঙ্ক বললেন তোমার স্তবে আমরা প্রসন্ন হয়েছে। তুমি অশ্বের পেটে ফু দাও তাহলে কুন্ডল পাবে। উতঙ্ক তাই করলেন এবং কুণ্ডল ফিরে পেলেন।


উতঙ্ক কুণ্ডল ফির পেয়ে ভাবছেন আজ উপাধ্যায়ানীর পুন্যক ব্রত কিভাবে এতো কম সময়ে কিভাবে তাঁর ইচ্ছে পুরন করবো। তখন সেখানে থাকা পুরুষ অশ্বের উপর আরোহন করতে বলাতে উতঙ্ক ক্ষনমধ্যে পৌছে গেলেন।


উপাদ্ধায়নী স্নান শেস করে কেশ সংস্কার করতে করতে উতঙ্ক এলেন না দেখে শাপ দিতে যাবেন ঠিক সেই সময় এসে প্রনাম করলেন কুন্ডল দিলেন উতঙ্ক। তারপর সকল কথা উপাধ্যায়ের কাছে গিয়ে জানালেন। তখন উপাদ্ধ্যায় বললেন তুমি যে দুই স্ত্রীকে বস্ত্র বয়ন করতে দেখেছো তারা ধাতা ও বিধাতা। কৃষ্ণ শেত সূত্র রাত্রী ও দিন, ছয় কুমার ছয় ঋতু, চক্রাট বছর। তাঁর ব্দাদশ মাস, যিনি পুরুষ তিনি সয়ং ইন্দ্র এবং অশ্ব অগ্নি। তুমি যাবার সময় পথে যে বৃষ দেখেছিলে সে ঐরাবত, তাঁর আরহী ইন্দ্র। তুমি যে পুরীষ খেয়েছো তা অমৃত। নাগলোকে তোমার বিপদ হয়নি, কারন ইন্দ্র আমার সখা, তাঁর অনুগ্রহে তুমি কুন্ডল আনতে পেরেছো। সৌম্য তোমাকে অনুমতি দিচ্ছি স্বগৃহে যাও, তোমার মংগল হবে।


উতঙ্ক ফিরে এলেন কিন্তু তাঁর মনে প্রতিশোধের আগুন জলতে লাগলো। তিনি হস্তিনাপুরে রাজা জনমেজয়ের কাছে গেলেন। তখন জনমেজয় তক্ষশিলা জয় করে ফিরে এসেছেন। মন্ত্রীরা তাঁকে ঘিরে আছেন। উতঙ্ক যথাবিধি আশীর্বাদ করে বললেন মহারাজ যে কার্য করা উচিৎ ছিল তা না করে আপনি বালকের ন্যায় অন্য কার্য করছেন। জনমেজয় তাঁকে সংবর্ধনা করে বললেন, আমি ক্ষাত্রধর্ম অনুসারে প্রজাপালন করে থাকি। আমাকে আপনি কি করতে বলছেন। উতঙ্ক বললেন আপনার পিতা মহাত্মা পরীক্ষিতের যে যে প্রানহরণ করেছে, নে দুরাত্মা তক্ষকের উপর আপনি প্রতিশোধ নিন। সেই নৃপতির চিকিৎসার জন্য কাশ্যপ আসছিলেন, কিন্তু তক্ষক তাকে ফিরিয়ে দিয়েছিল। আপনি শীঘ্র সর্পসত্রের অনুষ্ঠান করুন। এবং জ্বলিত অগ্নিতে সেই পাপীকে আহুতি দিন। তাতে আপনার পিতার মৃত্যুর প্রতিশোধ হবে, আমিও প্রীত হব। কারণ সেই দুরাত্মা আমার বিঘ্ন করেছিল।


উতঙ্কের কথা শুনে জনমেজয় তক্ষকের উপর অতিশয় ক্রদ্ধ হলেন এবং শোকার্তমনে মন্ত্রিগনকে পরীক্ষিতের মৃত্যুর বিষয় জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন।

নবীনতর পূর্বতন